চিংড়ি ঘেরের পাশ দিয়ে চলে গেছে সরু পাকা রাস্তা। রাস্তার ছাল বাকল কিছুই নেই। ফাঁকা জনবসতি। সবুজ খুব একটা চোখে পড়ে না। শুধু বিস্তীর্ণ চিংড়ি ঘের। সাত্তার মোড়লের বাড়ি আর কত দূর? দুরন্ত কিশোরদের উত্তর ঐতো সামনে সাত্তার সাহেবের বাড়ি। এভাবেই সাতক্ষীরা শহর থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূর কালীগঞ্জ। উপজেলা সদর থেকে আরো প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে বাঁশতলা বন্দকাঠির সেই বাড়ির সন্ধান মেলে। সামনে লোহার গেট। ভেতরে এলাহী কাণ্ড কারখানা। একেবারে ইউরোপ। যেন কাশ্মীরের ফুলের উদ্যান এনে এখানে বসানো হয়েছে। এরই মধ্যে নছিমন, ভটভটি ছুটে আসে। বাংলার এই যানে সওয়ার হয়ে সেজে গুজে নতুন কাপড় পরে গ্রামের সরল বধুরা তাদের সন্তানদের নিয়ে ছুটে আসেন। উদ্দেশ্য সাত্তার মোড়লের বাড়ি দর্শন।
আব্দুস সাত্তার মোড়ল সম্রাট শাহজাহান নন। তিনি তাজমহলের রূপকারও নন। তিনি একজন চিংড়ি ঘের ব্যবসায়ী। আর তিনি তাজমহল নির্মাণ করেননি। স্বপ্নের একটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন মাত্র। এই বাড়িটিই এখন দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। প্রতিদিন শত শত মানুষ বাড়িটি দেখতে আসেন। বেশির ভাগ সময় বাড়ির সামনে মিনি পার্কে বসে থাকেন সাত্তার। প্রিয়জনকে নিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করেন।
লোহার গেট পেরিয়ে ২০ গজের মত সামনে এগোলে বাড়িতে ঢোকার মূল দরজা। কিন্তু বাড়িতে ঢুকতে গেলেই পার হতে হবে একটি কাচের রাস্তা। পানির ওপর দিয়ে কাচের এই পথটি নির্মাণ করা হয়েছে। ঝুলন্ত সেতুর মতো পথের দুই ধারে পাইপের রেলিং। পাশে লাল পদ্ম আর শাপলা ফুটে রয়েছে। ঝরনাধারায় অবিরাম পানির নৃত্য। এদিকে কাচের রাস্তার নিচে খেলা করছে বড় বড় সব রুই মাছ। এই স্বচ্ছ কাচের সড়ক পার হয়ে যেতে হলো স্বপ্নের বাড়ি।
২০০৫ সালে কোটি টাকা খরচ করে বাড়িটি নির্মাণ করেছেন আব্দুস সাত্তার মোড়ল। নকশা করেছেন স্থপতি ফাল্গুনি মলি্লক। আধুনিক স্থাপনাশৈলীর ডুপ্লেঙ্ এই বাড়ির আয়তন ২৪০০ বর্গফুট। দোতলা বাড়িটিতে কক্ষ রয়েছে ৯টি। ছয়টি বেড আর তিনটি ড্রইং রুম। নিচতলার মূল ড্রইং রুমের সামনে শুধু কাচের দেয়াল। বাড়ির মেঝে ও সিঁড়িতে ব্যবহার করা হয়েছে বিদেশি মার্বেল পাথর ও টাইলস। ১০ বিঘা জমির ওপর বাড়িটি ফুলের মতোই ফুটে রয়েছে। পাশেই পুকুর। সেখানে বড় বড় মাছ। ওরা খাবার খায় বিশেষ ফিডারের সাহায্যে। রয়েছে মিনি পার্ক। পার্কে কংক্রিটের বেঞ্চ টেবিল। যে কেউ বসে গল্প করতে পারে। বাড়ির সামনে রয়েছে ফুলের বাগান। ১২ মাসই ফুল ফুটে থাকে। বেশির ভাগ ফুলই বিদেশি। এ ছাড়া রয়েছে আম, লিচুসহ নানারকম ফলের গাছের বাগান। সেখানে আছে শত শত পাখি।
বাড়ির সীমানার ভেতরেই আছে একটি প্রাইমারি স্কুল, মসজিদ ও মাদ্রাসা। মাদ্রাসায় পড়ছে ৪০০ শিক্ষার্থী। আর এসবের যাবতীয় ব্যয় বহন করেন সাত্তার মোড়ল। বাড়ি তৈরির নেপথ্য কাহিনী বললেন তিনি, ‘এই এলাকা খুবই অবহেলিত। সাতক্ষীরার বাইরে ঢাকা কিংবা অন্য কোথাও গেলে আমাদের ‘দক্ষিণে’ বলে ছোট করা হতো। আমি এই ‘দক্ষিণে’ নামটা ঘোচাতেই বাড়িটি বানিয়েছি। এখন সারা বাংলাদেশ থেকেই এ বাড়ি দেখার জন্য অনেকে আসেন। অনেক মন্ত্রীও এসেছেন। আতিথেয়তা করে আমি বেশ আনন্দ পাই।’ তিনি আরো বললেন, ‘কতজনকে মানুষ কত নামে চেনে। বাড়িটির কারণে আমাকে লোকে চিনছে এতেই আমার আনন্দ। অজপাড়া গাঁয়ে এখন বাড়ি দেখার জন্য যারা এতকাল আমাদের দক্ষিণে বলেছে, তারাই ছুটে আসছে।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS