সাগর বনানী মধূপ কূজনে সাতক্ষীরা মোহময়।
পথিক সুজনে ডাকে নিরজনে প্রাণের বারতা কয়।।
দেশের সীমানা নদীর ঠিকানা যেথা গিয়েছে হারিয়ে।
সেথা সাতক্ষীরা রূপমায়া ঘেরা বনানীর কোলে দাঁড়িয়ে।।
এক অনির্বচনীয় নান্দনিক অনুভবের প্রাচীন জনপদ সাতক্ষীরা একদা রাজা প্রতাপাদিত্যের যশোহর রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। বারোভূঁইয়াদের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী এ জেলার কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর এলাকায়। সাতক্ষীরা বাংলাদেশের নৈঋত কোণে অবস্থিত, দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা; যার পূর্বে খুলনা, উত্তরে যশোর, পশ্চিমে পশ্চিমবংগের চব্বিশপরগনা এবং দক্ষিণে মায়াময় সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর। ৩৮৫৮.৩৩বর্গকিমি আয়তন বিশিষ্ট এ জেলার এক তৃতীয়াংশ সুন্দরবন(১৪৪৫.১৮বর্গকিমি),যা জেলার মোট আয়তনের ৩৭.৫৩%।এ জেলার অবিনাশী অহঙ্কার সুন্দরবন ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যের অংশ, রামসার সাইট হিসাবে নির্বাচিত এবং অন্যতম প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য। এ অঞ্চলের মানুষের ভাষা, কৃষ্টি, জীবনবোধ, ধর্ম, পূজা-পার্বণ, সংস্কৃতি, পেশা, আচার-অনুষ্ঠান বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে সুন্দরবন যেমন মানুয়কে রক্ষা করে,তেমনি তাদের জীবন-সংগ্রামে সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগায়, করে তোলে আত্মনির্ভরশীল।বহু উদ্ভিদ এবং নানা প্রাণী সমৃদ্ধ সুন্দরবন বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার- এর আবাসস্থল যা পর্যটন সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।
একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্চ মোকাবেলায়, মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে, জনগণের চিরায়ত প্রত্যাশা পূরণে এবং জেলার অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনে জেলা তথ্য বাতায়ন বাতিঘরের ভূমিকা পালন করবে।
জেলা প্রশাসনের পটভূমি:
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অব ডাইরেক্টরস ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে দেশীয় দেওয়ানের পদ বিলোপ করে কালেক্টরকে স্থানীয় প্রশাসনের স্থায়ী ইউনিট করার সিদ্ধান্তগ্রহণ করে এবং রাজস্ব প্রশাসন সিভিল জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট ইত্যকার অফিসকে কালেক্টরের অফিসের সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য সুপ্রিম কাউন্সিলকে নির্দেশ প্রদান করে। উক্ত আদেশের প্রেক্ষিতে মেকপারসন (Macpherson) ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ প্রদেশকে ৩৬টি জেলায় বিভক্ত করে প্রত্যেক জেলায় একজন কালেক্টর নিয়োগ করেন। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে কালেক্টরকে আইন-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব ম্যাজিস্ট্রেসী ক্ষমতা প্রদান ও রাজস্ব আদায়ের সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয় এবং একজন জজের অধীনে নেয়া হয়। রাজস্ব বোর্ড বিলোপের মাধ্যমে কালেক্টরের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপীল শ্রবণের জন্য চারটি সার্কিট কোর্ট গঠন করা হয়। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিভাগীয় কমিশনার এসব সার্কিট কোর্টের স্থলাভিষিক্ত হন এবং ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তবিভাগীয় কমিশনার দেওয়ানি ফৌজদারি ও রাজস্ব বিষয়ক মামলার আপীল শ্রবণ করতেন। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশক্রাউন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে ভারত শাসনের ক্ষমতা নিজ হাতে নেবার পর ভুমি রাজস্ব প্রজাস্বত্ব দণ্ডবিধি ফৌজদারি কার্যবিধি ইত্যাদির ক্ষেত্রে আইন পাশ করে। ফলে কালেক্টরের কতিপয় প্রশাসনিক ও ডিসক্রিশনারী ক্ষমতা কমে যায় যদিও কালেক্টরকে রাজস্ব আদায় ও জেলার আইন শৃঙ্খলার সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে কালেক্টরকে ফৌজদারি বিচার নিস্পত্তির ক্ষমতা অর্পণের মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেট নামকরণ করা হয় এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ করা হয়। জেলা জজ এর আদালতকে দায়রা আদালত এবং কলিকাতার দেওয়ানি আদালতকে আপীল আদালত হিসেবে নামকরণ করা হয়। বিভাগীয় কমিশনারকে রাজস্ব মোকদ্দমার ক্ষেত্রে আপীল আদালত হিসেবে রাখা হয়। কালক্রমে জেলা পর্যায়ে অন্যান্য বিভাগীয় অফিস সৃষ্টি করা হয়।
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে স্যার জর্জ ক্যামবেল (Campbell) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর ক্ষমতাকে আরও সুদৃঢ় করেন। এ সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরকে জেলা পর্যায়ে অন্যান্য বিভাগীয় অফিসের কাজকর্মের তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা প্রদান করার মাধ্যমে তাঁকে জেলা পর্যায়ের প্রধান নির্বাহী ও প্রশাসক হিসেবে গড়ে তোলা হয়। মন্টেগো চেমস-ফোর্ড ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি লেজিসলেটিভ কাউন্সিল গঠনের বিধান করেন। এতে জেলা ম্যাজিস্ট্রট এর ক্ষমতা ও প্রভাব বহুলাংশে কমে যায় যদিও তাঁকে রাজস্ব আদায় ও ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশের উপর নিয়ন্ত্র্রণ ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে আইন-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। এছাড়াও তাঁকে জেলা পরিষদ সহ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিদর্শন এবং এতদসংক্রান্তপ্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণের ক্ষমতা দেয়া হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন মত প্রকাশ করে যে, কালেক্টর জেলা প্রশাসনের প্রধান হিসেবে পুলিশ সুপার ও অন্যান্য কারিগরী বিভাগের প্রধানগণের উপরে থাকবেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পর থেকে সমগ্র দেশকে বিভাগ, জেলা ও মহকুমা এবং থানা পর্যায়ে প্রশাসনিক ইউনিটে রূপান্তর করা হয়। এ সময় জেলা প্রশাসন শক্তিশালী ইউনিট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কালেক্টর/জেলা ম্যাজিস্ট্রেট/ডেপুটি কমিশনার জেলার প্রধান নির্বাহী হিসেবে পুলিশ সুপার ও অন্যান্য কর্মকর্তার উপর তদারকী ও সমন্বয়মূলক ভূমিকা পালন করতে থাকেন।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বিভাগ, জেলা, মহকুমা ও থানা প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে বহাল থাকে এবং জেলা প্রশাসন এক্ষেত্রেও শক্তিশালী ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকে। জেলা প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট/কালেক্টর/জেলা প্রশাসক জেলার রাজস্ব আদায়, আইন শৃংখলার সার্বিক দায়িত্ব ও ফৌজদারি বিচার প্রশাসনসহ আন্তবিভাগীয় কাজের সমন্বয় সাধন করেন। যদিও ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ডেপুটি কমিশনার/কালেক্টর/জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পুলিশ সুপারসহ অন্যান্য বিভাগীয় কর্মকর্তাগণের এসিআর লিখন এবং সমন্বয়মূলক ক্ষমতা খর্ব করা হয় তথাপিও পরবর্তীতে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় প্রয়োজনে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানকে পুনরায় আন্তবিভাগীয় কাজ-কর্মের সমন্বয়ের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। বর্তমানের জেলা প্রশাসক সাধারণ প্রশাসন, রাজস্ব প্রশাসন ফৌজদারি বিচার প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ,উন্নয়ন প্রশাসন ছাড়াও জেলা পর্যায়ের আন্তবিভাগীয় কাজের সমন্বয় সাধনের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাদৃত।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস