বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সাতক্ষীরা জেলার অবস্থান। এ জনবসতি প্রাচীনকালে খ্যাত ছিল বুড়ন দ্বীপ নামে। এর পাশে চন্দ্রদ্বীপ, মধুদ্বীপ, সূর্যদ্বীপ, সঙ্গদ্বীপ, জয়দ্বীপ ইত্যাদি দ্বীপ খ্যাত ছোট ছোট ভূখণ্ডের অবস্থান পাওয়া যায় প্রাচীন ইতিহাস ও মানচিত্রে।
ঠিক কোন সময় থেকে বুড়ন দ্বীপে সমাজবদ্ধভাবে মানুষের বসবাস শুরু হয় তার বিস্তারিত ও সঠিক তথ্য প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। রামায়ণ মহাভারতের তথ্যানুযায়ী এ অঞ্চলের সংঘবদ্ধ মনুষ্য বাসতির গোড়াপত্তন প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্ব থেকে। মহাভারতের তথ্যানুযায়ী মুনি কপিল পাইকগাছার কপিলমনিতে একটি কালিমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে পূজা দেন। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং পূজা দেওয়ার কাজটা তিনি করেছিলেন মহাভারতের যুগে।
আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সনে। তাঁর ভারত আক্রমণের সময় গঙ্গার মোহনায় গঙ্গারিডি নামের একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমান সাতক্ষীরা জেলাটি ছিল এ রাষ্ট্রের অধীন। আলেকজান্ডারের পর মৌর্য ও গুপ্ত যুগে বুড়নদ্বীপ ছিল পুণ্ড্রভুক্তির অন্তর্গত। বুড়নদ্বীপ এ সমেয় পরিচিত ছিল খাড়িমণ্ডল নামে। চন্দ্র বর্মণ খাড়ি অঞ্চল দখল করেনেন চতুর্থ শতকে। এর পর বৌণ্যগুপ্ত (৫০৭-৫২৫) দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার স্বাধীন নরপতি হিসেবে রাজ্য শাসন করেন।
সপ্তম শতকে শশাঙ্ক, ভদ্রবংশ, খরগোরাত ও লোকনাথ বংশ রাজত্ব করছিলেন এ জনপদে।
রাজা শশাংক ছিলেন ইতিহাস খ্যাত নরপতি।
This district most probably came under the authority of Sasanka, the ruler of Gauda, in to beginning of the 7th century A.D. Sasanka occupies a prominent place in the history of Bengal, as he is the first king of Bengal who extended his suzerainty over territories bar beyond the geographical limits of the territories of Bengal.
সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে খুব সম্ভবত অত্র জেলা গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের কর্তৃত্বাধীনে আসে। বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন শশাঙ্ক। তিনিই বাংলার প্রথম শাসনকর্তা যিনি শুধু বাংলা নয় বরং বাংলার ভৌগোলিক সীমারেখার বাইরেও বহুদূর পর্যন্ত তাঁর সার্বভৌমত্ব বিস্তৃত করেছিলেন।
রাজা শশাঙ্ক নিজে রাজ্যকে শুধু ভৌগোলিক অবস্থানে সুদৃঢ় করে ক্ষান্ত থাকেননি। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে বেশ কয়েকটি রাজ্য দখল করেন ও বৃদ্ধি করেন নিজ রাজ্যের সীমানা। পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (খ্রিঃ ৬৩৪) যে ভ্রমণ বৃত্তান্ত দিয়েছেন তাতে গঙ্গারিডি রাজ্যের উল্লেখ পওয়া যায়। এর সময়ের গঙ্গারিডি পুণ্ড্রবর্ধন, কর্ণসুবর্ণ, কজংগল, তাম্রলিপ্তি, সমতট প্রভৃতি নামে খ্যাত ছিল। ‘বর্তমানের সাতক্ষীরা জেলা এই সমতটেরই অংশ’।
অষ্টম থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় পাল ও বর্মণ রাজারা শাসন করেন বুড়নদ্বীপ। তাঁদের আমলে সভ্যতা, সংস্কৃতির শ্রীবৃদ্ধি ইতিহাস খ্যাতি লাভ করেছে বৌদ্ধ ইতিহাস ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি নামে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী পাল আমলে দশম শতকে দক্ষিণ পূর্ব বাংলায় স্বাধীন রাজা ছিলেন চন্দ্র বংশের রাজা ত্রৈলক্য চন্দ্র ও শ্রী চন্দ্র (৯৩০-৯৫৭)।
চন্দ্র রাজের সময় দক্ষিণ বঙ্গ ছিল সমৃদ্ধ জনপদ। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চন্দ্রবংশের নৃপতিরা বেশ কিছুকাল জনপ্রিয় শাসক ছিলেন এ জনপদে। শ্রী চন্দ্রের পর কল্যাণ চন্দ্র (৯৭৫-১০০৩ খ্রিঃ), লড়হচন্দ্র (১০০০-১০২০ খ্রিঃ), তার পরবর্তী রাজা গোবিন্দ চন্দ্র (১০২০-১০৪৫খ্রিঃ)। চন্দ্র বংশের সবচেয়ে প্রতিপত্তিশালী রাজা হিসেবে গোবিন্দ চন্দ্র ইতিহাস খ্যাত। তিনি চোল রাজ রাজেন্দ্র চোলের কাছে পরাজিত হলে দক্ষিণ অঞ্চলের শাসন ভার চলে যায় পাল বংশের হাতে।
একাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে পাল রাজারা দাপটের সাথে দক্ষিণ অঞ্চলে নিজেদের শাসন কাজ পরিচালনা করেন মহীপাল (৯৯৫-১০৪৫), তৃতীয় বিগ্রহ পাল (১০৫৮-১০৭৫), দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭৫-১০৮০খ্রিঃ), রামপাল (১০৮২-১১২৪ খ্রিঃ) প্রমুখ। পাল রাজাগণ ছিলেন ইতিহাসখ্যাত নৃপতি।
ইতিহাস খ্যাত কৈবতর্ক বিদ্রোহ হয়েছিল একাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে। রামপাল এ সময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। কৈবর্ত বিদ্রোহের ফলে দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গে উত্থান ঘটে বর্মদের। এ বংশের খ্যাত পুরুষ ব্রজবর্ম। পরে তাঁর পুত্র জাতবর্ম বহু যুদ্ধে জয়লাভ করে সার্বভৌমত্ব অর্জন করেন। কলচুরি রাজকর্ণের একখানি শিলালিপিতে (১০৪৮-১০৪৯ খ্রিঃ) উল্লিখিত আছে জাতবর্ম খুলনা জেলাসহ দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চন্দ্র বংশের রাজাকে ধ্বংস করেন। জাতবর্ম কেবলমাত্র নিজের বাহুবলে অঙ্গ কামরূপ ও বরেন্দ্রে স্বীয় প্রাধান্য স্থাপন করে খুলনা জেলাসহ দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্ম বংশের অপরাপর শাসকরা হলেন-হরিবর্ম, সালবর্ম, ভোজবর্ম প্রমুখ। বঙ্গে বর্ম পরবর্তী রাজত্ব শুরু সেন বংশের। সেন বংশের আবির্ভাব সম্পর্কে ইতিহাস দৃঢ় কোন তথ্য দিতে পারে না। এ বংশের তৃতীয় নৃপতি বিজয় সেনের আমলটি খ্যাত একটি সময়। তাঁর শাসনামল ছিল ১০৯৭ থেকে ১১৬০ খ্রিঃ পর্যন্ত। তিনি খণ্ড বিভাজন শোষণ ব্যবস্থার আওতায় এনে প্রচলন করেছিলেন কেন্দ্রীয় শাসন।
Succeeded in supplanting the Varmans from the south-eastern Bengal and the pales from the north and north-western Bengal. Thus Vijay Sena had established the rule of the Senas over the whole of Bengal.
বিজয় সেন ছিলেন শৈব। এছাড়া সেন আমলের যে শিলালিপি ও ফলক পাওয়া গেছে তা থেকে জানা যায় এঁরা ছিলেন চন্দ্র বংশীয় ব্রহ্ম ও ক্ষত্রিয়। বিজয় সেনের পুত্র বল্লাল সেন (১১৬০-১১৭৮ খ্রিঃ) সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বাগড়ি নামক এলাকায় প্রশাসনিক বিভাগ সুদৃঢ় করেন। বাগড়ি অঞ্চলের পরিচয় ও উৎপত্তি বিষয়ে জানা যায়-
“উপবঙ্গ নদী ও জঙ্গলে সমাচ্ছন্ন ছিল। বোধ হয় বাগুরি বা বাউরি জাতির নামানুসারে বাগড়ি নাম হইয়াছে। উপবঙ্গের গঠন-কালে বারংবার আগ্রেয় উৎপাত ঘটিয়াছিল। কলিকাতা অঞ্চল খনন করিয়া দেখা গিয়াছে, সে প্রদেশের অরণ্য, অরণ্য-জন্তুসহ বারংবার বসিয়া গিয়াছিল। বঙ্গ ও উপবঙ্গ, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাদ (মেঘনা) ও গঙ্গার ব-দ্বীপে গঠিত। রাঢ়, বরেন্দ্র, বঙ্গ ও মিথিলা পূর্ব হইতেই ধন-জন-পরিপূর্ণ ছিল; কিন্তু বাগড়িতে মনুষ্যের বাস ছিল না।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস